বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন মানেই ক্লাস, পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশান আর সিজিপিএ বাড়িয়ে নিতে পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করা। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়টা আসলে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে এক্সপ্লোর করাও সময়? সেই সাথে নতুন নতুন দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা অর্জনেরও গুরুত্বপূর্ণ সময় এটি।
এটি সত্য যে- আপনার অর্জিত ডিগ্রী আর সিজিপিএ ক্যাম্পাস পরবর্তী জীবনে ক্যারিয়ার গঠনে সহায়তা করবে। তবে ক্লাস রুমের বাইরে অর্জিত জ্ঞান আপনার সারা জীবন চলার পথে কাজে দেবে বৈকি। এমনকি বর্তমান তুমুল প্রতিযোগীতার যুগে ভালো ক্যারিয়ার গঠনে পড়াশোনার পাশাপাশি কো-কারিকুলামের বিকল্প নেই।
আর তাই জীবনকে শুধুই পাঠ্য বইয়ের মলাটে আর ইট-পাথরে ঘেরা চার দেয়ালের ক্লাস রুমে আবদ্ধ না করে ক্লাসের বাইরের জগৎ থেকেও নানান অভিজ্ঞাতা আর শিক্ষা নিয়ে জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন অভিজ্ঞতা আর বৈচিত্রময়তায় ভরিয়ে দিন; ভবিষতের জন্যে হাজারো স্মৃতি তৈরী করুন, সেই সাথে মানুষের বাস্তব জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমুহের পাশাপাশি পারিবারিক অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করুন; আর এভাবে নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করুন। ভিন্ন পরিবেশ আর নানা প্রান্ত থেকে আগত হাজার শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখরিত আপনার ক্যাম্পাস আপনার জীবনের নানা বৈচিত্রের দ্বার খুলে দিতে উন্মুখ হয়ে আছে, দরকার শুধু নিয়মিত ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে নিজেকে মেলে ধরার।
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীরা জানার সুযোগই পায়না যে- বিশ্ববিদ্যালয় আসলে কত বড় একটি জায়গা যেখানে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকলেও; যে কেউ আন্তরিক ভাবে চাইলে নিজেকে ভালোভাবে গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পড়াশোনার পাশাপাশি আরো যা করতে পারেন সেসবেও একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকঃ
১। ইংরেজী চর্চা ক্লাবে জয়েন করতে পারেনঃ
আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই শুরু করে দিন ইংলিশ চর্চা যা সবচেয়ে বেশি আপনাকে সহায়তা করবে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যেতে। অখণ্ড অবসরে ইংরেজিতে কথা বলার জন্য গ্রুপ বানিয়ে নিন, আড্ডা-ইংলিশ চর্চা দুটোই চলবে সমানে। কিংবা চাইলে জয়েন করতে পারেন কোন ইংলিশ ক্লাব, কোচিং অথবা ইংলিশ ডিবেট ক্লাবে।
২। প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনঃ
আপনি যে সেক্টরেই কাজ করতে চান না কেন কম্পিউটার ও অন্যন্য প্রযুক্তির উপর দখল থাকা চাই। তাই ক্লাসের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এক্সেল আর পাওয়ার পয়েন্ট জানার পাশাপাশি জেনে নিন ফ্যাক্স, স্ক্যানার, প্রিন্টার আর ফটোকপি মেশিন কিভাবে কাজ করে কিংবা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সমূহে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ই-মেইল আদান-প্রদানের সঠিক নিয়ামাবলী সহ অন্যন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে দক্ষতাসমূহ যা আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে।
৩। পার্ট টাইম জব শুরু করতে পারেনঃ
পড়াশোনার পাশাপাশি অখন্ড অবসরে সম্ভব হলে আগ্রহ আছে এমন সেক্টরে পার্ট টাইম জবও করতে পারেন যাতে করে আপনার অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে যা পরবর্তী জীবনে কাজে আসবে। এখানে আপনি নিজেকে ম্যানেজ করার পাশাপাশি নিদিষ্ট ইন্ডাষ্ট্রি সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হবে, নতুন নতুন কাজ শেখার সাথে সাথে নতুন লোকজনের সাথে মেশারও সু্যোগ হবে যা পার্সোনাল নেটওয়ার্ক তৈরীতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
৪। নিজেকে সামাজিক সংগঠনে সম্পৃক্ত করতে পারেনঃ
আপনি চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এর বাইরে যে কোন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন। এতে করে সামাজিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আত্নার তৃপ্তি যেমন পাবেন তেমনি নানা রকম দক্ষতা যেমনঃ সময়ানুবর্তীতা, সহযোগিতামূলক মনোভাব, ব্যাক্তিত্বের পরিপক্ষতা, ধৈর্যশীলতার শিক্ষা অর্জন করতে পারবেন এবং সেই সাথে অর্গানাইজিং ক্যাপাবিলিটি, দ্রুত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, নেতৃত্বগুণ সহ বেশ কিছু বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে পারবেন।
৫। ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারেনঃ
এসবের বাইরেও ভ্রমন নামে আরো ভিন্ন এক জগৎ রয়েছে আপনার-আমার জন্য। অখণ্ড অবসরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়তে পারেন কোন নতুন জায়গাতে। প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতি আর মানুষের দেখা মিলবে। আর এতে করে আপনার যে শিক্ষা অর্জিত হবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রুমে নাও পেতে পারেন।
নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া শুধুমাত্র মানসিক প্রশান্তিই এনে দেয়না বরং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায়ও এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর ভিন্ন সংস্কৃতি তথা নানা রকম মানুষের দেখা পাওয়া, খুব কাছ থেকে মানুষের জীবন আর জীবিকা দেখার এক দুর্লভ সুযোগ কেবল ভ্রমনের মাধ্যমেই সম্ভব। তাইতো এন্থোনি বোরডেইন তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন “আপনার বয়স যদি ২২ বছর হয়, আপনি যদি শারীরিকভাবে ফিট হোন তবে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে ক্ষুধার্ত থাকুন; সেক্ষেত্রে অধিক ভ্রমন করুন, প্রয়োজনে ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়ুন এবং দেখুন কত ভাবেইনা লোকজন জীবন–যাপন আর খাবার সংগ্রহ করে এবং রান্না করেন। তাদের থেকে শিখুন–আপনি যেখানেই যান না কেন।”
৬। শিক্ষকবৃন্দ এবং এলাইম্নিদের সাথে কার্যকরী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুনঃ
পাঠ্যবইয়ের মলাটের লিপিবদ্ধকৃত লিখা গুলোর চেয়ে একজন শিক্ষকের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মূল্য কোন অংশে কম নয়; তাই সম্ভব হলে আপনার শিক্ষকমন্ডলীর কাছ থেকে নানা বিষয়ে জানার চেষ্টা করুন, নিয়মিত যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিন।
যেকোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার এলাইম্নিকে ‘ব্র্যান্ড এম্ব্রেসাডর’ হিসেবে গণ্য করে থাকেন। এই এলাইম্নিদের সাথে একটি কার্যকরী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেন যাতে করে তাদের কর্ম জীবনের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে আপনি চাইলে অনেক কিছু শিখতে পারেন যা আপনার পরবর্তী সময়ে বেশ কাজে আসবে। সব চেয়ে ভালো হয় যে ইন্ডাষ্ট্রি বা সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী সেই সেক্টরে কর্মরত লোকজনের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলুন।
৭। ক্যারিয়ার বিষয়ক ওয়ার্কশপ-সেমিনারে অংশ নিনঃ
পড়াশোনা শেষে কাঙ্ক্ষিত জব পেতে কি ধরণের ট্রেনিং আর ডেভেলপমেন্ট দরকার তা জেনে নিতে সচেষ্ট হোন এবং ক্যারিয়ার বিষয়ক ওয়ার্কশপ-সেমিনারে অংশ নিন। কারণ আপনি চাইলেই কাঙ্ক্ষিত চাকুরীটি পাবেন না যদিনা আপনার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা আর দক্ষতা না থেকে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়ঃ কোন প্রতিষ্ঠানের প্রকিউরম্যান্ট বিভাগে কাজ করতে চাইলে আপনাকে ভালো নেগোশিয়েটর হতে হবে, সাপ্লাইয়ারদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এমতাবস্থায় আপনার মধ্যে যদি পরিচিত কিংবা অপরিচিতদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইতস্ততা বোধ কাজ করে তবে আপনাকে তা কাটিয়ে উঠার জন্যে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের সহায়তা নিতে হবে। বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন নিজেকে অধিক দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, নিয়মিত নিজের স্কিলস শানিত করতে হবে এবং কর্ম ক্ষেত্রে প্রতিদিনকার কাজ সুষ্টভাবে সম্পাদন করার পাশাপাশি নিজেকে যোগ্য হিসবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে নতুন কিছু শিখতে হবে প্রতিনিয়ত।
৮। বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারেনঃ
পড়াশোনার পাশাপাশি দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে নিজেকে শাণিত করতে পারেন। এই প্রতিযোগীতা কুইজ থেকে শুরু করে প্রজেক্ট ওয়ার্ক, বিজনেস কেইস কম্পিটিশান, প্রেজেন্টেশান, বিতর্ক, আবৃত্তি ইত্যাদি যে কোনটি হতে পারে। আমাদের দেশে অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও অনেক সময় নানান প্রতিযোগীতার আয়োজন করে থাকেন, সেসবে অংশ গ্রহণ করে নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে পারেন।
এসবের পাশাপাশি নিকট ভবিষতের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দরকারি নেতৃত্ব গুণ আর সাংগঠনিক দক্ষতা রপ্ত করতে কিংবা নিজেকে আরো ভালোভাবে মেলে ধরতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ক্লাব, বিজনেজ ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, টুরিস্ট ক্লাব, ব্লাড ডোনেট, আবৃত্তি, বন্ধুসভা ও সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন সহ নানান কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন যা গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী জীবনে বিস্তর কাজে আসে।
বিশ্ববিদ্যায় এমন এক ক্ষেত্র যেখানে ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে হাজারো রকম মানুষের দেখা মেলে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে দেশের প্রায় জেলা থেকে বৈচিত্র্যময় হাজারো শিক্ষার্থীরা এসে প্রাণের মেলা বসায়; সংস্কৃতির পাশাপাশি চিন্তা-চেতনার আদান-প্রদান হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এই প্রাণের মেলাতে ঘুরে নিজেকে জানার পাশাপাশি বিশ্বের নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসায়, চিকিৎসা ও বৈচিত্রময় জীবন-জীবিকা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার অফুরান সুযোগ যেন কারো হাতছাড়া না হয়।
শেষ কথা, শুধু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে যেমন চলবে না, তেমনি শুধুমাত্র কো-কারিকুলার নিয়ে পড়ে থাকলেও হবেনা বরং এই দু’য়ের মাঝে ব্যালেন্স করে এগিয়ে যেতে হবে। আর ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে যেখানেই হোক না কেন সর্বদা নতুন কিছু শেখার উপর জোর দিন, নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সর্বদা কাজ করুন; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়ে গেলেও লার্নিং প্রসেস যেন বন্ধ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে সফল হতে হলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নতুন ধ্যান-ধারণা আর প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই।
আরো পড়ে নিতে পারেন-
সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের দরকারি ৭ পরামর্শ…
কোথায় পাবেন কর্পোরেট জব সার্কুলার?
কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা সমূহ যা আপনাকে এগিয়ে দেবে…
কর্পোরেট জগতের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনি কতটুকু প্রস্তুত?
Follow me on Facebook . Check out my Website .
7 Comments
ধন্যবাদ স্যার
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]