জীবন ও একজন আলি বানাত

ক্যারিয়ার নির্বাচনের আদর্শ সময় কোনটি? আপনার ক্যারিয়ার পরিকল্পনাইবা কী?
April 4, 2018
ছাত্ররাজনীতিঃ মধ্যবিত্তের একান্ত ভাবনা
July 7, 2018

জীবন ও একজন আলি বানাত

বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে কাঙ্খিত ও মর্যাদাপূর্ণ মাস পবিত্র রমজান ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। পবিত্র গ্রন্থ কোরআন নাযীলের মাস তথা রহমত-মাগফিরাত আর নাজাতের এই মাসে সীয়াম সাধনার পাশাপাশি যাকাত – ফিতরা আদায়পূর্বক ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে মহিমাম্বিত এই রামাদানের সমাপ্তি ঘটে। পরিবার-পরিজন‚ আত্নীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার পর সবাই যে যার কর্মস্থলে মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু এই রামাদানেই আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী – ক্যান্সার আক্রান্ত এক তরুণ মুসলিম ভাইকে হারিয়েছি যিনি পরপারে গিয়েও বেচেঁ আছেন সহস্র মানুষের হৃদয়ে। আসুন তবে জেনে নিই কে সেই তরুণ যিনি মৃত্যুর পূর্বে মানবতার কল্যাণের জন্য অসাধারণ সব কাজ করে গেছেন।

 

আলি বানাত, ইঊটিউবের কল্যাণে আপনি হয়তো ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে জন্ম নেওয়া মিলিওনিয়ার এই তরুণের নাম শুনেও থাকবেন। যিনি তরুণ বয়সেই নিজ ব্যবসায়ের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ–সম্পদের মালিক হন। ৬ লাখ ডলারের ফেরারি স্পাইডারে চড়া আর লুইস ভুটনের প্রায় লাখ টাকা মূল্যের সেন্ডেল ব্যবহারে অভ্যস্ত আলি বানাত পরিকল্পনা করেছিলেন ত্রিশ পেরুলেই কর্ম-জীবনের ইতি টেনে নেমে যাবেন জীবনকে আরো অন্যরকম ভাবে উপভোগ করতে।

 

কিন্তু আল্লাহ্‌ তায়ালা যেখানে আমাদের সবার চেয়ে উত্তম আর মহা পরিকল্পনাকারী সেখানে তার সৃষ্ট মানুষের করা পরিকল্পনা কতটুকুইবা কাজে আসে? তাইতো হঠাৎ করেই উচ্চ বিলাসী এই তরুণের চতুর্থ স্টেইজের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ডাক্তার তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম সত্য মৃত্যুর জন্য তৈরি হওয়ার সংবাদ দিয়ে মাত্র ৭ মাস সময় বেঁধে দেন।

 

আমাদের সাধারণের চোখ আর আপাতঃ দৃষ্টিতে ব্যাপারটিকে ভয়ানক আর মর্মস্পর্শী বলেই মনে হবে কিন্তু এই আলি বানাত নিজের ভয়াবহ ক্যান্সাসের খবরে যা বলেছেন তা শুনলে যে কারোর জীবনে নতুন উপলব্ধি আসতে পারে। প্রচণ্ড বিলাস বহুল জীবনে অভ্যস্ত তরুণ আলি বানাত তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াকে আল্লাহ্‌’র পক্ষ থেকে তার জন্য একটি উপহার স্বরূপ নিয়েছেন কারণ এই ঘটনা তাকে আল্লাহ্‌’র পথে ফিরে আসতে এবং জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে।

 

বর্তমান সময়ে সিডনির মতো শহরে বসবাস করে ঈমানের স্তর কতটা দৃঢ় হলে এভাবে আল্লাহ্‌’র উপর বিশ্বাস রাখা যায় তা ভাবনার বিষয়। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার এই ঘটনা তার জীবনে বৈচিত্রময় পরিবর্তন নিয়ে আসে; যে পরিবর্তনের কারণের মানুষের কল্যাণে তিনি তার অর্জিত সকল সম্পদ ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সম্পদ বিহীন খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। একে কে তিলে তিলে গড়ে তোলা সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যত্নে গড়া তোলা স্বপ্নের বাড়ি, বিলাসবহুল ফেরারি গাড়ি সব বিক্রি করে দেন! দুনিয়ার সকল মোহ ত্যাগ করে নিলামে তোলেন তার সৌখিন সব জিনিস পত্রও। অবশেষে সব অর্থকড়ি নিয়ে পাড়ি দেন পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ টোগোতে এবং গরীব মুসলিমদের সহায়তা করার জন্যে গড়ে তুলেন ‘Muslim Around The World / MATW’ নামে চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। নিজের অর্থ আর পরিশ্রমের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার–প্রচারণার মাধ্যমে ডোনেশন সংগ্রহও চলতে থাকে।

 

MATW গঠন করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে নানা রকম সামাজিক কল্যাণের প্রজেক্ট হাতে নেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে ১.৫ মিলিয়ন ডলারের বাজেটে বিধবা-আর এতিম শিশুদের জন্য beach front village নামে এক পল্লী গড়ে তুলেন যেখানে ২০০টি বাড়ির পাশাপাশি রয়েছে মসজিদ, স্কুল-কলেজ, মেডিক্যাল সেন্টার। এমনকি মানুষের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি দরকারী জিনিস পত্রের সহজলভ্যতার জন্য রয়েছে প্রয়োজনীয় সংখ্যাক দোকান-পাটও।

 

পাশাপাশি হাতে নিয়েছিলেন TSEVIE project, এতিমদের জন্য স্পেশাল প্রজেক্ট Orphan house , বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য Water well project , Islamic cemetery এবং Qurban & Food Distribution Project যার মাধ্যমে গত বছর ১ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের মাঝে কোরবানীর গোস্ত বিতরণ করা হয়।

 

আলি বানাতের MATW’র কার্যক্রম শুধুমাত্র টোগোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকার আরেক মুসলিম দেশ সোমালিয়াতেও। যেখানে Emergency Aid Project, Feeding the fasting প্রজেক্ট সহ অন্যন্য সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি হাতে নেন ইসলামী DAWAH প্রজেক্টের। এই প্রজেক্টের আওতায় অল্প দিনেই ৫ হাজার মানুষ ইসলামের দাওয়াত কবুল করে মুসলিম হিসেবে পরিগণিত হোন। এই বিপুল সংখ্যাক নিউ মুসলিমদের জন্য আলি বানাত নিজ নামে সহ গড়ে তোলেন মোট ১৩ টি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার।

 

আলি বানাত যেখানেই মুসলিমদের সমস্যা দেখেছেন, চেষ্টা করেছেন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে। বার্মায় রোহিঙ্গা নিধনের সময়ও আলি বানাতের MATW “Rohinga Emergency Aid Appeal” নামের প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছুটে এসেছে খাদ্য-নগদ অর্থ সহায়তার মাধ্যমে পাশে দাঁড়াতে। তাদের পরিকল্পনা ছিলো রোহিঙ্গাদের জন্য বাঁশের তৈরি ২০০০ ঘর ও কিছু মসজিদ নির্মাণের কিন্তু সেটা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি কারণ মুসলিম যুবক আলি বানাতের দুরারোগ্য ক্যান্সার তখন বেশ মাথা চড়া দিয়ে উঠেছিলো।

 

চলতি রমজানে একদিকে যেমন লেবাননের ত্রিপোলীতে গরিব-দুস্থদের জন্য ৫৬৩ প্যাকেট খাবার সাম্রগ্রী বিতরণের প্রস্তুতি চলছিলো; অন্যদিকে আলি বানাতও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার খোদার সাথে সাক্ষাতের। উনার মরণঘাতী ক্যান্সারের প্রকোপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের মে মাসে ক্যান্সার ধরা পড়লে উনার ডাক্তার ৭ মাস সময় বেঁধে দিয়েছিলেন আর মহান আল্লাহ্‌তায়ালা উনাকে প্রায় ২৫ মাস সময় দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণে কাজ করে অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। গত মে মাসের ২৯ তারিখে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য; অবিচল থেকেছেন এক আল্লাহ্‌’র একত্ববাদে, আর বিদায় নিতে দেখা গেছে পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ করতে করতে।

 

তার এই তরুণ বয়সে চলে যাওয়া আমাদের জন্য একদিকে যেমন মৃত্যু নামক অঘোষিত বার্তার বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে ইহ-জগৎ ত্যাগ করেও যেকেউ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারেন সেই বার্তাও দিয়ে গেলেন মুসলিম এই আদর্শবান তরুণ।

 

লিখাটি শেষ করবো আত্ম-উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ডেনিস ওয়েটলির জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অন্যরকম ঘটনা দিয়ে। ঘটনাটি ১৯৭৯ সালের। ডেনিস ওয়েটলি শিকাগো থেকে লস এঞ্জেলসে যাবেন বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। ব্যস্ততা সামলে নিয়ে শিকাগো ওহারা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখেন দেরি হয়ে গেছে। তিনি দৌড়ে টার্মিনালে পৌঁছে দেখেন গেইট বন্ধ হয়ে গেছে। বিমানে ওঠার সিঁড়ি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। গেইট কিপার মহিলাকে তিনি বিমানটি থামানোর জন্যে অনুনয়‚ অনুরোধ‚ তর্ক-বিতর্ক সবই করলেন কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না বরং চোখের সামনে বিমানটিকে রানওয়ে দিয়ে চলে যেতে দেখলেন।

 

রাগে ক্ষোভে ঝড়ের বেগে তিনি ফিরে এলেন টিকিট কাউন্টারে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর জন্য। তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হলো। তিনি লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়ই জানতে পারলেন‚ যে বিমানে তার যাওয়ার কথা ছিলো‚ তা আকাশে উঠার সাথে সাথে বিধ্বস্ত হয়েছে। বিমানের একটি ইঞ্জিন ভেঙ্গে রানওয়েতে পড়ে যায়। হাইড্রোলিক লাইন ও কন্ট্রোল কেবল ছিঁড়ে যায়। পাইলট বিমানটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। বিমানের আরোহী ও ক্রু সবাই নিহত হয়।

 

আপনি কী বলবেন ডেনিস ওয়েটলির জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটিকে? কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন একে? আসলে আমি-আপনি যে বেঁচে আছি‚ শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি‚ প্রতিদিন রাতে ঘুমিয়ে সকালে ঘুম থেকে স্বাভাবিকভাবে জেগে উঠছি – এটাইতো অনেক বড় রহমত যার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না। ডেনিস ওয়েটলিও তার প্রতিক্রিয়ায় তা-ই বলেছিলেন যেমনটি বলেছিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণ আলি বানাতও।

 

মানব জীবন মনে হয় আসলে এমনই হাজারো বৈচিত্র্যে ভরপুর যার নিয়ন্ত্রক কেবল মাত্র আল্লাহ্ তায়ালা‚ যিনি আপনার-আমার চেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী।

 

উৎসঃ MATW, YouTube এবং আমার সহ ধর্মিণী অনেক তথ্য উপাত্ত  দিয়ে সহায়তা করেছেন।

জেনে নিন কর্পোরেট জগতের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনি কতটুকু প্রস্তুত?

Follow me on Facebook . Check out my Website .

Hossain Joy
Hossain Joy
Hossain Joy is a seasoned professional in the corporate world, bringing a wealth of experience and insights to the table. With a successful career spanning 12 years, he has navigated the intricacies of the corporate landscape with resilience and determination. Hossain Joy is not only an accomplished writer but also a mentor who is passionate about sharing the valuable lessons learned throughout his journey. He has authored the inspiring book "Journey to My First Corporate Job," offering a compelling narrative of his early career experiences, challenges, and triumphs. In addition to his book, Hossain Joy extends his reach through a thought-provoking blog, where he imparts practical advice and wisdom gained from years of corporate life. He aims to guide and inspire young professionals, providing them with the tools to navigate their own paths to success. Whether through the written word or personal mentorship, Hossain Joy remains dedicated to empowering the next generation of professionals, fostering a community of growth, resilience, and achievement. Connect with Hossain Joy on Facebook.com/Hossain.Joy for more insights and updates on his journey and upcoming projects.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *