মজলুম বনাম জালিম:
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অর্থ : ‘(হে রাসুল!) আপনি বলুন, হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ২৬)
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেলেন তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। উনি নিজেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। তো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই আনন্দে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঐদিন ছাত্রছাত্রীরা মিলে আনন্দের আতিশয্যে মিছিল করেছি। ঐদিন বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিলো। উনি আমাদের জন্য বিশাল গৌরব বয়ে এনেছিলেন। এরপর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় উনার নামে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি ভবনের নামকরণ করে যা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভবন হিসেবে পরিচিত।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে গ্র্যাজুয়েশনের শেষ দিকে এসে যখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় আসলো তখন আমাকে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত সোশ্যাল বিজনেস বা বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসায়ের উপর রিপোর্ট জমা দিতে বলা হলো। ততদিনে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত Social Business মডেলটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসায়ের প্রথম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গ্রামীণ-ড্যানোন। ফ্রান্সের বিখ্যাত দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ড্যানোন এবং প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ মিলে জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারের মাধ্যমে গড়ে তুলেন গ্রামীণ-ড্যানোন ফুডস লিমিটেড। এর লক্ষ্য স্থানীয় লোকদের জন্য ব্যবসা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দারিদ্র্য হ্রাস করা, কারণ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় দুধ সহ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা মালিকপক্ষ নিবেন না বরং এর পরিবর্তে তারা জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নের নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য এই মুনাফা পুনঃ বিনিয়োগ করবেন। তাই একে ‘সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ’ বলা হয়। এই উদ্দেশ্য নিয়ে একটি ইয়োগার্টের উৎপাদন কারখানাও স্থাপন করা হয়। এই ইয়োগার্টের বাণিজ্যিক নাম ‘শক্তি দই’। বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে ফিল্ড ভিজিট করে, উক্ত সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে জড়িত কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত পূর্বক গুগলের সহায়তা নিয়ে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। সেই থেকে সোশ্যাল বিজনেসের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি হলো আমার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষের দুই বছরের মধ্যে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত সোশ্যাল বিজনেস প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার মনে আছে, চাকুরীর ইন্টারভিউতে আমি খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এবং সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেতে উদগ্রীব ছিলাম। আত্মবিশ্বাসী ছিলাম কারণ আমি আগেই এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে রিসার্চ কাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল টার্ম পেপার প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছিলাম। অবশেষে উক্ত প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তো তখন ২০১২ সাল। বাংলাদেশের ক্ষমতায় তখন বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ। আমাদের প্রতিষ্ঠান এবং এর সংশ্লিষ্ঠ সবাইকেই অসহনীয় কষ্ট আর হাজারো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করতে হয়েছে নিত্যদিন। এমনও হয়েছে যে, তৎকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা লোকজন পণ্য পরিবহনের ডেলিভারি ভ্যান পর্যন্ত আটকে দিয়েছে এবং ডেলিভারি ভ্যানে থাকা লোকজনকেও মারধর করেছে। এমন অনেক দিন গেছে সকালে অফিসে গিয়ে দেখি নানা অজুহাতে তত্কালীন সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ অফিস ঘিরে রেখেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে অফিসে ঢোকার জন্য। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই কাজ করেছি। এরমধ্যে বিশ্বনন্দিত প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের সাথে গুটি কয়েকবার দেখা করার, কথা বলার সুযোগ হয়েছে। যতবারই উনার সান্নিধ্য পেয়েছি উনাকে যথেষ্ট প্রাণবন্ত, দিলখোলা, নির্ভেজাল, নিরহংকারী অসাধারণ একজন মানুষ মনে হয়েছে। উনার সহজ-সরল মনোভাব সবাইকেই আকৃষ্ট করতে বাধ্য।
এরপর আমরা কম বেশি সবাই জানি যে, দীর্ঘ এক যুগের অধিক সময় ধরে উনার সাথে বিগত স্বৈরাচার সরকার কি রকম অন্যায় আচরন করেছে। আমি বিশ্বাস করি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে উনাকে অপমান অপদস্থ করা হয়েছে, এমনকি বিশ্বনন্দিত এই মানুষটিকে আদালতের কাঠগড়ায় পর্যন্ত দাঁড়াতে হয়েছে। যার ঝুলিতে রয়েছে প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার এবং এ যাবৎ সারা পৃথিবীর অন্তত ৪৮ টি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেছে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সারা জীবন লোকজন উনাকে সুদখোর বলে গালি দিয়েছে। যারা ওনাকে গালি দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন: হত্যা, গুম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, এবং সর্বশেষে ডিক্টেটরশিপ বজায় রাখতে হাজার হাজার নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানো কি খুব ভালো কাজ ছিলো? আল্লাহ দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জাহানে নিশ্চয়ই এসবের বিচার করবেন। ইতিমধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত বিচারের সামান্য নমুনা আমরা বিশ্ববাসী দেখে ফেলেছি। আমরা ভুলে গেছি সম্মান দেওয়ার এবং তা কেড়ে নেবার মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা; যা তিনি পবিত্র মহা গ্রন্থ আল কুরআনের সুরা আল-ইমরানের ২৬ নাম্বার আয়াতে বলে দিয়েছেন।
আজকে আরেকটা আনন্দের দিন, আজকে আর একটা মিছিল করতে ইচ্ছে করছে। যে মিছিল মজলুম প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ দেশের সকল মজলুম ও নির্যাতিত ছাত্র-জনতার পক্ষে, জালিমের বিপক্ষে। সব শেষে এটাই বলবো যে, আল্লাহ সবাইকে বুঝ দান করুন, যেন আমরা অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের পথ চলতে পারি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১। প্রফেসর মীর সোহেল, মার্কেটিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
২। রাশেদুল হাসান, তৎকালীন এইচ আর হেড, গ্রামীন-ড্যানোন ফুডস লিঃ
৩। সুলতান মাহমুদ, তৎকালীন সেলস হেড, গ্রামীন-ড্যানোন ফুডস লিঃ
৪। আবুল কালাম আজাদ, তৎকালীন রিজিউনাল সেলস ম্যানেজার, গ্রামীন-ড্যানোন ফুডস লিঃ
৫। দীপেশ নাগ, বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর, গ্রামীন-ড্যানোন ফুডস লিঃ
৬। তৎকালীন গ্রামীন-ড্যানোন ফুডস লিঃ এ কর্মরত আমার সকল সহকর্মী বৃন্দ।