বছরের শুরুর দিন আমার সাবেক কলিগ জীবনের ফোন কল। মার্কেট ভিজিটে গিয়ে সরাসরি আলাপের পর আমি নিজেও ওর কলের অপেক্ষায় ছিলাম। বেশ কিছুদিন যাবত বেচারার উপর দিয়ে অনেক ধকল যাচ্ছে। বেশ প্যাঁরা উপর আছে সে। তো ফোনে আলাপ করে মনে হলো বেচারার মনে একটু হলেও স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। কথা বলে মনে হয়েছে সে তাঁর আসল গ্রাহক চিনতে ভুল করেছিলো এবং অন্যান্য বিভাগের সহকর্মী ও তাঁর নিজের টিমের সদস্যদের সাথে আরো ভালো যোগাযোগ রক্ষা করে চলা উচিৎ ছিলো যা সে এতোদিন করেনি। এসব মেনটেইন করে চলতে পারলে তাঁর দৈনন্দিন কাজে প্যাঁরা কমে আসতো। তাঁর এসব সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমার বেশ ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে আমাদের বিগত দিনের আলাপ চারিতা কিছুটা কাজে দিয়েছে।
যাইহোক, জীবন এবার আমার কাছে বাজার সদাইয়ের হিসেব নিয়ে জানতে চায়। সংসারের খরচাপাতি নিয়েও সে বেশ প্যাঁরার মধ্যে আছে। কর্মক্ষেত্রের মতো এখানেও বেশ টানাপোড়েন রয়েছে।
আচ্ছা জীবন, আপনি যেহেতু আয়-ব্যায়ের বিষয়ে পরামর্শ চাইছেন- আমাকে কী আপনার গত ছয় মাসের ব্যাক্তিগত আয়-ব্যায়ের হিসেব সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারেন? তাহলে আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে অল্পস্বল্প শেয়ার করতে পারবো।
বস, যা বেতন পাই তার থেকে বাসা ভাড়া দেই, মাসিক বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল সহ বাজার-সদাই যা যা লাগে করি। ব্যাংক লোন বাবদ একটা কিস্তি প্রতি মাসেই পরিশোধ করি; বাড়িতে মা-বাবাকে অল্প কিছু দিয়ে হাতে আর তেমন কিছু থাকেনা। মাসের বিশ-বাইশ তারিখের পর হাত একেবারে খালি হয়ে যায়। এরপর মাসের শেষ কয়টা দিন খুব টেনে টুনে যায়। কি আর বলবো বস আপনাকে। এর উপর আমার ছোট্ট একটা বাচ্চাও আছে। ওর জন্য বাড়তি কিছু খরচ করতে হয়। সব মিলিয়ে আসলে লেজে গোবরে অবস্থা।
একটানা কথা গুলো বলে জীবন একটু থামলেন। মোবাইলের এপাশ থেকে আমি জীবনের দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ অনুভব করলাম। আমার কাছে মনে হলো এরকম দীর্ঘশ্বাসের কথা হরহামেশায় শুনে থাকি। বলা যায়, এসব অধিকাংশ মধ্যবিত্তের খুব পরিচিত বাস্তব চিত্র এটি।
জীবনকে উদ্যেশ্য করে আমি প্লাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে মারলাম। আচ্ছা জীবন, আপনার কাছে কী লিখিত হিসেব নিকাশ হবে ? কোথায় কোথায় কত খরচ করলেন? আই মিন আপনি কী বাজেট তৈরি করে খরচ করেন নাকি খরচ হচ্ছে তো খরচ করছেন এমন?
বস, লিখে কিংবা বাজেট করে কখনো খরচ করি নাই; বেতন পেয়ে যা যা লাগে খরচ করি, জীবনের তড়িৎ জবাব।
আমি প্রশ্ন রাখি, আপনিতো সেলসে জব করেন; মাসিক সেলস টার্গেট আর এচিভম্যান্টের হিসেব নিকাশ কীভাবে করেন বলেন তো শুনি?
জীবন এবার খুব গুছিয়ে বলা শুরু করলেন। বস, প্রাপ্ত টার্গেটকে মাসিক কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করে দৈনিক ভিত্তিতে অর্জনের চেষ্টা করি। তাছাড়া শুরুতেই টিমের সবাইকে যার যার টার্গেট ভাগ করে দিয়ে দিই। এরপর দৈনিক ভিত্তিতে মনিটর করি। সপ্তাহান্তে হিসেব মিলিয়ে দেখি কত পার্সেন্ট হলো আর কত পারসেন্ট বাকি রইলো। মাসের শেষ কয়েকটা দিন টার্গেট নিয়ে অতিরিক্ত মনোযোগী হই। প্রয়োজনে টিমের সাথে আলাপ করে দরকারি সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আর টার্গেট নিয়ে আমার রিপোরটিং বস এর প্যাঁরাতো সারাক্ষণ লেগেই থাকে। আপনিতো বস এসব আমার চেয়েও অনেক ভালো জানেন এবং বুঝেন।
এইযে টার্গেট নিয়ে এতো কিছু করেন, এতো শ্রম দেন, প্যারার উপর থাকেন; কিন্তু এসব করে মাস শেষে যে কয়েক হাজার টাকা আয় করেন, সেই টাকা হিসেব না করে এতো সহজে পরিকল্পনাবিহীন খরচ করেন কীভাবে? আমাকে একটু বলেন তো দেখি? তার উপর আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি এখন চরমে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী খাদ্যে এই মুদ্রাস্ফীতির হার ১২% এর অধিক।
বস, এভাবে তো কখনো ভেবে দেখি নাই, বেশ নরম স্বরে জীবনের জবাব।
কিন্তু ভাবতে তো আপনাকে হবেই হবে। নিজের আয়ের কষ্টের টাকা কোথায় কীভাবে খরচ করবেন সেটার একটা তালিকা থাকা উচিৎ। মাসের শুরতেই আয় ব্যয়ের একটা বাজেট তৈরি করা চাই। তাহলে মাসের শেষে আপনি বুঝতে পারবেন কোথায় টাকাটা আপনি খরচ করেছেন। এতে করে পরের মাসের বাজেট তৈরি আপনার জন্যে সহজ হবে। এভাবে কয়েক মাস পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রেখে খরচ করলে আপনি বুঝতে পারবেন কোথায় এবং কোন খাতে কত অর্থ খরচ করা উচিৎ, কোথায় খরচের লাগাম টেনে ধরা দরকার ইত্যাদি। এর সাথে অন্তত ৫০০ টাকা হলেও মাসের বেতন আলাদা করে রাখুন ভবিষ্যৎ সঞ্চয় হিসেবে। আর এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঞ্চয়ের প্রবনতা বাড়বে যা অত্যন্ত জরুরী।
আমার এই জবার শুনে জীবন একদম চুপ হয়ে রইলেন। মনে হলো জীবন বেচারা জীবনে বহুত বড় ভুল করে ফেলেছেন, এখন এক এক করে সব বের হচ্ছে।
আপনি কী আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?
চুপ করে আছে যে জীবন?
বস, সারাদিন চাকুরীর ধকল সামলে এসব হিসেব নিকাশ কখন করবো? জীবনের চটপট জবাব।
শুনেন ভাই জীবন, আয়-ব্যয়ের মাসিক বাজেট তৈরি না করে খরচ করলে সারাজীবন এই প্যাঁরার মধ্যেই ঘুরপাক খাবেন। দিন, মাস, বছর যাবে; বেতনও বাড়বে কিন্তু সন্ধ্যায় বাজার ঘুরে বাসায় যাওয়ার পর ঠিকই মাথা আগের মতোই ঝিমঝিম করবে। যদি এর থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে চান তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী খরচের অভ্যাস করেন। প্রতিদিনের খরচ লিপিবদ্ধ করে রাখার অভ্যাস করুন।
বস, বেতনও তেমন একটা বাড়ে না। এতো প্যাঁরা নিয়েও খুব একটা সেলস ইন্সেন্টিভ পাই না। টি এ, ডি এ থেকে তো কিছু টেকেনা। একটু পরামর্শ দেবেন কীভাবে বিগ বসদের নজরে পড়তে পারি যাতে করে মোটা অংকের ইনক্রিমেন্ট কিংবা প্রমোশন পেতে পারি?
জীবন, প্রথম কথা হচ্ছে আয় বাড়লেও আপনি যদি অপরিকল্পিত ভাবে ব্যয় করেন তবে আয় বাড়িয়েও খুব একটা লাভ হবেনা। আয় বৃদ্ধি পাবে, ব্যয়ও সমান তালে বাড়তে থাকবে। জানেন তো, মানুষের চাহিদার শেষ নেই। আপনি বরং একটি স্বল্প মেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং সেই অনুযায়ী খরচের খাত নির্বাচন করে প্রায়োরিটির ভিত্তিতে ব্যয় করতে শিখুন। তাহলে এক সময় আপনি মানি ম্যানেজম্যান্ট বা আর্থিক ব্যবস্থাপনা বুঝে যাবেন, আপনার প্যাঁরাও কমে আসবে।
দ্বিয়ীয়তঃ আপনি জিগ্যেস করেছেন কীভাবে বিগ বসদের নজরে পড়বেন। আপনি যদি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সুনজরে আসতে চান তবে অবশ্যই আপনাকে অধিক পরিশ্রমী হতে হবে। অন্যদের চেয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, অফিসের কাজে সময় একটু বেশি দিতে হবে; সব সময় বাড়তি কিছু করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে এবং এই বাড়তি অংশটুকুই আপনাকে দিনশেষে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে।
সাধারণত আমরা নিজের আয়ের উৎসকে নিরাপদ রাখতে যতটুকু না করলেই নয়, ততটুকু কাজই করতে অভ্যাস্ত। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেতন বৃদ্ধি কিংবা প্রমোশন সবই কিন্তু আপনার কাজের ফলাফল। আর তাই অধিক বেতনাদীর আশা করলে আপনাকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে জানতে হবে এবং কখনো কখনো দায়িত্বের বাইরে গিয়েও কাজ করতে হতে পারে। তবেই না আপনি নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার প্রত্যাশা করতে পারেন, তাই না?
বোঝা গেল ব্যাপারটা?
জি বস, ক্লিয়ারলি বুঝতে পেরেছি।
বুঝলে চুপ করে আছেন যে?
আজকের কথা গুলো বেশ ভারী ভারী লাগছে। মানি ম্যানেজম্যান্ট বিষয়টা আমার কাছে একদমই নতুন। সামনাসামনি হলে আরো ভালো হতো। আমাকে কী আরেকবার দেখা করার সুযোগ দেবেন বস? জীবনের জিজ্ঞাসা।
দেখুন, দেখা তো করাই যায়। কিন্তু আমি যা যা আপনাকে বললাম সেগুলো আগে প্র্যাক্টিস করেন। দেখেন আপনার জীবনে প্যাঁরা কমে কিনা, তারপর না হয় একদিন সাক্ষাৎ হবে ইন শা আল্লাহ্।
ঠিক আছে বস। অনেক কিছু জেনেছি আপনার থেকে। আমি অবশ্যই এসব মেনে চলার চেষ্টা করবো, দেখি প্যাঁরা কমাতে পারি কিনা।
আজকে তাহলে এখানেই শেষ করছি, কী বলেন?
জি বস, থ্যাঙ্ক ইউ।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম জীবন, ভালো থাকবেন। দোয়া করি মহান রব যেন আপনার প্যাঁরা কমিয়ে দিয়ে আপনার ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনকে স্বাচ্ছন্যময় করে তুলেন।
আরো পড়ুন- কর্মজীবনে প্যাঁরা কমাবেন কীভাবে?