বেশকিছু দিন আগেও মোবাইল ফোন রাজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো নকিয়ার, আর আজ নকিয়ার অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আমরা সবাই জানি। ২০০৭ সালের দিকে অ্যাপল মোবাইল মার্কেটে টাচ স্কিনের স্মার্ট ফোন নিয়ে হাজির হলে মার্কেট শেয়ার হারাতে থাকে নকিয়া। অ্যাপলের সাথে স্যামস্যাংও নতুন প্রযুক্তি সহায়তায় সমান পাল্লা দিয়ে বাজার দখল করতে থাকে। অপর দিকে নিজেদের দূরদর্শিতার অভাব আর সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ৫০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিটি মাত্র ৭ বিলিয়নে মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি হয়ে যায়!
আরো অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে – স্টিভ জবস আর তার দুই বন্ধু মিলে ১৯৭৬ সালে একটি গ্যারেজে যাত্রা শুরু করা মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপল এর বর্তমান বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে; আগস্ট’২০১৮ তে এসে পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠানে । এর পেছনে রয়েছে আধুনিক সব প্রযুক্তি আর পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে প্রতিষ্ঠানটির তাল মিলিয়ে চলার মানসিকতা।
সর্বোপরি নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হওয়া অ্যাপল ঘটনা পরিক্রমায় এক সময় দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটলেও নিজেদের দূরদর্শিতার কারণে নানা চড়াই–উৎরাই পেরিয়ে এখন বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলারের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি!
ছোট্ট এই গল্পটি বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিজনেজ দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে আপনাকেও দূর দৃষ্টি সম্পূর্ণ হতে হবে, নিজের স্কিলস শানিত করতে হবে এবং শিখতে হবে প্রতিনিয়ত। কর্ম ক্ষেত্রে প্রতিদিনকার কাজ সুষ্টভাবে সম্পাদন করতে এবং নিজেকে যোগ্য হিসবে প্রতিষ্ঠা করতে যে দক্ষতাগুলো আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে আসুন সুগুলো জেনে নেওয়া যাকঃ
টাইম ম্যানেজমেন্টঃ
সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা আপনাকে সর্বদা অল্প সময়ে অধিক কাজ করতে সহায়তা করবে ফলে আপনি সময় বাঁচিয়ে নিজেকে অধিক লার্নিংয়ে নিয়োজিত করতে পারবেন। এবং সঠিক সময়ে কাজ সম্পূর্ণ করার কারণে কর্মক্ষেত্রে আপনি চাপ মুক্ত থাকবেন; আর কাজের প্রতি ফোকাস অনেক বেড়ে যাবে যা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে সফল হতে সহায়তা করবে। আমরা সবাই জানি কর্মক্ষেত্রে আমাদেরকে প্রতিনিয়তই নিদিষ্ট ডেডলাইন মেনে চলতেই হয় যেখানে সবাইকেই সময়ের ব্যাপারে সর্বচ্ছো সচেতন থাকতে হয়। আর নিদিষ্ঠ সময়ে কাজ শেষ করা মানে অফিসে অতিরিক্ত সময় অবস্থান না করে বরং সময়টা আপনি পরিবার -পরিজনের সাথে ভাগ করে নিজেকে পরের দিনের জন্য রিফ্রেশ করতে পারবেন এবং এটা আপনাকে অফিসের কাজের ক্ষেত্রে নব – উদ্যোম আর প্রেরণা যোগাবে।
পজিটিভ মনোভাবঃ
কর্মক্ষেত্রে পজিটিভ মনোভাব সাফল্যলাভে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমান সময়ে ব্যাবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়; যার ফলে দ্রুত নানান রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়, স্ট্যাটেজি আর পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়। আবার অনেক সময় নিজ কাজের বাইরেও অনেক অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব হাতের কাছে চলে আসে। আর এসব ক্ষেত্রে সর্বদাই পজিটিভ থেকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। অন্যদিকে পজিটিভ মনোভাব সম্পূর্ণ যে কেউই অন্যের কাছে অনুকরনীয় হয়ে থাকেন। পজিটিভ মনোভাবের অনুশীলন আপনাকে কাজের চাপ দূর করতে সহায়তা করবে, আত্নসম্মান আর আত্নবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে এবং আপনাকে অধিক কর্মক্ষম আর ইউনিক করে তুলবে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে যদি আপনি তাদের এবং তাদের কাজের প্রতি পজিটিভ মনোভাব পোষণ করেন। যে কোন ব্যাপারে অজুহাত দাঁড়করানো , সংকীর্ণতা , সহকর্মীদের দিকে তীর ছুঁড়ে মারা, অন্যকে নিয়ে নেগেটিভ কথাবার্তা বলা, সহজেই হাল ছেঁড়ে দেওয়া, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি নেগেটিভ মনোভাব হিসেবে বিবেচিত হয়।
দলগত ভাবে কাজ করাঃ
একটি ভালো টিম বলতে আমরা বুঝি যে দলে নিদিষ্ট কতগুলো কোয়ালিটি বিরাজমান থাকে যেমনঃ একে অন্যকে বিশ্বাস করা, নিজেদের মধ্যে ভালো আন্তঃযোগাযোগ রক্ষা করা, দলের সদস্য হিসেবে নিজ দায়িত্বের বাইরেও দলের জন্য কাজ করা, পরিবর্তনের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করলে একদিকে যেমন দক্ষতা বিনিময় বা পেশাদারীত্বের উন্নতি হয় , তেমনি যে কোন কাজও খুব সহজে সম্পূর্ণ করা যায়। তাছাড়াও দলের একেক জনের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন আইডিয়া আর হরেক রকম অভিজ্ঞতা শেয়ারিং হয়, কাজের চাপ কমে, বাড়ে যোগাযোগ দক্ষতা আর নেটওয়ার্কিং যা পরবর্তী সময়ে সফল ক্যারিয়ার গঠনে ভূমিকা রাখে।
যোগাযোগ দক্ষতাঃ
আপনি যদি বিগত কয়েক বছরের জব সার্কুলার দেখে থাকেন তবে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে প্রায় সব জব সার্কুলারেই অন্যতম চাওয়া ছিল ‘ ভালো যোগাযোগ দক্ষতা’। এ থেকেই বোঝা যায় যে দ্রুত বর্ধনশীল বিজনেস দুনিয়ায় যোগাযোগ দক্ষতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলে কার্যকর যোগাযোগ শুধুমাত্র ভুলবোঝাবুঝি বা দ্বন্দ্ব থেকেই রেহাই দেয়না, বরং ব্যাক্তি তথা পুরো কোম্পানির উৎপাদনশীলতা তথা কর্মক্ষমতাকেই বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। বেটার যোগাযোগ দক্ষতার মাধ্যমেই আপনি আপনার টিমম্যাট , কলিগ, লাইন ম্যানেজার, ক্লায়েন্টস তথা কাস্টমারদের কাছে সুন্দর ও সাবলীল ভাবে আপনার বক্তব্য তুলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেন, পারেন সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতেও যা অবশ্যই আপনার ক্যারিয়ারকেও এগিয়ে নেবে।
কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতাঃ
কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা আপনার দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে কাজে অধিক মনোযোগী করে তুলবে; আপনি অর্পিত দায়িত্বের প্রতি অবহেলা না করে বরং শতভাগ সৎ থেকে কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হবেন। ফলে ব্যাক্তিগত পারফরম্যান্সের উন্নতি হয় আর সহজেই সফলতা ধরা দেয়। কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আপনার কোম্পানির লাভ – ক্ষতি, পণ্য বা সার্ভিসের গুনগতমান আর ব্যাবসার স্বার্থ নিয়ে ভাবতে শেখাবে, কোম্পানির জনবলের প্রতি অন্যায় কাজ আর রুঢ় আচরণ থেকে রক্ষা করে সবার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের উৎসাহ যোগাবে, ক্রেতা সন্তুষ্টি তথা প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের প্রতি দায়িত্বশীল ও যত্নবান করে তুলবে, কোম্পানির ইমেজ ক্ষুণ্ণ হয় এমন কাজ থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করবে।
দ্রুত সমস্যা সমাধানের দক্ষতাঃ
বিজনেস ওয়াল্ডে প্রতিনিয়তই আপনাকে হাজারো রকম চ্যালেঞ্জ আর সমস্যার মুখোমুখি হতেই হবে। আর সেই সাথে আপনাকে এইসব সমস্যার দ্রুত আর কার্যকরী সমাধান দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কার্যকর ‘সমস্যা সমাধানের দক্ষতা’ যে কাউকে যে কোন সমস্যা বিচার – বিশ্লেষণ করে, সমস্যার গভীরতা নিরুপণ পূর্বক সঠিক ও যুক্তিযুক্ত সমাধান খুঁজে পেতে সহায়তা করে। দ্রুত ও কার্যকরী সমস্যা সমাধানের এই গুণ আপনাকে সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করে দেবে যা আপনাকে ক্যারিয়ারে অনেক সাফল্যও এনে দিতে পারে। সাধারণত এর জন্য দরকার মানসিক দক্ষতা আর বিশ্লেষণমূলক ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
কর্ম ক্ষেত্রে আসলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা আসে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, লাইন ম্যানেজার থেকে দীক্ষা নিয়েও সমাধান করা শেখা যায়, কোম্পানির রুলস এবং রেগুলেশন অনুযায়ী সমাধান করা যায়, অনেক সময় পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ীও সমাস্যার সমাধান করা যায়। অনেককে আবার “সমস্যা সমাধানের মডেল” ব্যাবহার করেও নানা রকম সমস্যার সমাধান করতে দেখা গেছে। তবে অভিজ্ঞতার ভান্ডার যত সমৃদ্ধ হবে, সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও তত বাড়তে থাকবে।
নমনীয়তা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাঃ
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে আমরা ইংরেজিতে এডাপ্টেবিলিটি বলে থাকি। একবিংশ শতাব্দীতে নিয়োগকর্তাগণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণ লোকদেরকেই তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ প্রযুক্তি আর সমাজ খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে , প্রতিনিয়ত আমরা নানা রকম বৈচিত্র্যতার মুখোমুখি হচ্ছি; এমন অবস্থায় আসলে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান এমন কাউকেই প্রাধান্য দেবে যে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হবে, বেশ নমনীয়তার সহিত উদ্ভোত চ্যালেঞ্জ গুলোর মোকাবেলা করবে এবং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সব পরিকল্পনা সব সময় কাজ নাও করতে পারে তখন পরিস্থিতি অনেক সময়ই অনূকুলে থাকে না, এমন সব পরিস্থিতির সাথে খুব দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অবশ্যই থাকা চাই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার এই অসাধারণ ক্ষমতা আপনাকে আপনার সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলবে।
চলবে…
Follow me on Facebook . Check out my Website .
5 Comments
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]