জিসান মাহমুদ (ছদ্মনাম), দেশের বাইরের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক শেষ করে দেশে ফিরেছেন। ভেবেছিলেন বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে আসামাত্র নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরী পেয়ে যাবেন কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা! চাকুরী দূরে থাক একটি ইন্টার্ভিউ কল পাবার জন্য মুখিয়ে ছিলেন অনেক মাস পর্যন্ত। আসলে তিনি দেশের বাইরে থাকায় আমাদের জব মার্কেট সম্পর্কে তেমন ধরণা ছিলনা উনার, পরিপূর্ণভাবে জানা ছিলনা জবের সোর্স আর উৎস সমূহের, ছিলনা তেমন কোন কর্পোরেট নেটওয়ার্ক কিংবা দেশের বেশীরভাগ ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের মতো তারও কোন মেন্টর ছিলনা যিনি ক্যারিয়ার শুরু করার জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এমতাবস্থায় আর সবার মতো জিসান মাহমুদও এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করে হতাশায় অনেক দিন কাটিয়েছেন আর প্রহর গুনেছেন একটি চাকুরীর আশায়। আবার পরিবার ও বন্ধু মহলের এক ধরণের চাপ ছিলো যেহেতু দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েটদের অবস্থাও খুব একটা সুখকর না। শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী না হওয়ায় পড়াশোনা শেষে প্রায় সব গ্র্যাজুয়েটদেরকেই কঠিন অবস্থার মধ্যেদিয়ে যেতে হয়।
আবার মিসবাহ আরেফিন (ছদ্মনাম), ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে জুনিয়র অফিসার হিসেবে। বছর খানেক কাজ করার পর যোগ দেন দেশীয় একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে এবং সেখানে বছর দুয়েক কাজ করার পর এখন উনি সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এফএমসিজিতে কাজ করার পাশাপাশি এই সেক্টরে দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্যারিয়ার গড়তে কিন্তু তিনি কিছুতেই সুযোগ পাচ্ছেন না ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরে কাজ করার কারণে।
আসলে উপরের দুই জনের সমস্যার হচ্ছে সঠিক ক্যারিয়ার পরিকল্পনার অভাবে। একেবারে সরাসরি বললে বলতে হয় একজন ক্যারিয়ার মেন্টরের অভাবে। এসব ক্ষেত্রে কর্পোরেট জগতে অনেক বছর ধরে কাজের অভিজ্ঞতা আছে এমন একজনের সহায়তা নিলে সহজেই সমস্যার সমাধানের উপায় বের করা যায়।
সত্যিই আপনি যদি ক্যারিয়ারে গ্রো করতে চান তবে এখনই আপনার ক্যারিয়ার যাত্রায় অন্যদেরও যুক্ত করে নিতে পারেন। আমি আসলে একজন মেন্টরের কথা বলছি যিনি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে আপনাকে অসংখ্য অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন, আরো স্ট্যাটেজিক্যালি চিন্তা করতে সহায়তা করতে পারেন এবং আপনার সাফল্যের দরজা খুলে দিতে অসাধারণ সব ভুমিকা রাখতে পারেন। কতক মেন্টর আপনার পুরো ক্যারিয়ারেই অবদান রেখে যেতে পারেন, কেউবা নিদিষ্ট সেক্টরের চাকুরীতে মেন্টর হিসেবে ভুমিকা রাখতে পারেন; কেউবা নিদিষ্ট প্রজেক্টে মেন্টর হিসেবে আপনাকে সফলতা পাইয়ে দিতে পারেন। কতিপয় মেন্টর আপনাকে মেন্টি হিসেবে বেছে নিতে পারেন, আবার আপনি চাইলে আপনার জন্য কাউকে মেন্টর হিসেবে নির্বাচিতও করতে পারেন। আসুন মেন্টর – মেন্টি ও মেন্টরশীপ নিয়ে বিশদ জেনে নেওয়া যাকঃ
মেন্টর থেকে আপনার চাওয়া:
আপনি যদি কাউকে মেন্টর হিসেবে চান তবে ঠিক করে তার কাছ থেকে আপনি কি কি চাচ্ছেন। একজন মেন্টর তার অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাকে কেবল সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, প্রেরণা যোগাতে পারেন কিন্তু কর্মক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো আপনাকেই মোকাবেলা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার উন্নয়ন করাও আপনারই কাজ।
একজন মেন্টর খুঁজে নিনঃ
প্রথমে আপনি যে প্রফেশনে আসতে চান কিংবা বর্তমানে যে প্রফেশনে আছেন সেই প্রফেশনের অভিজ্ঞ কাউকে মেন্টর বানাতে চেষ্টা করুন যিনি আপনার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন এবং তার কাছ থেকে আপনি প্রচুর শিখতে পারবেন। চাইলে কর্মক্ষেত্র কিংবা পরিচিত নেটওয়ার্ক থেকেও মেন্টর খোঁজে নিতে পারেন। মেন্টর নির্বাচনে প্রয়োজনে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সহায়তা নিন। মনে রাখবেন–শুধু আপনি চাইলেই যেকেউ আপনার মেন্টর হতে রাজি হবে ব্যাপারটা আসলে এমন নয়; যাকে মেন্টর বানাতে চান তারও এক্ষেত্রে সম্মতি থাকতে হবে।
নিয়মিত সাক্ষাৎ করুনঃ
দুনিয়ার কেউই আপনাকে পরিবর্তন করতে পারবে না যদিনা আপনি না চান। নিজের সময়, চিন্তা আর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে রেজাল্ট বয়ে আনতে মেন্টরকে জানুন এবং আপনার সম্পর্কেও বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দিন। সম্ভব হলে দু’জনে নিয়মিত বিরতিতে সাক্ষাৎ করুন। এক্ষেত্রে জায়গা হিসেবে মেন্টরের অফিসকে বিবেচনা করা যেতে পারে, চাইলে কফি শপে যেতে পারেন কিংবা কোন হাঁটার জায়গাকেও বেঁছে নিতে পারেন। তাতে করে একসাথে কথাও বলা যাবে আবার ব্যায়ামও হবে আর তাতে দু’জনেই চনমনে অনুভব করবেন এবং মন খুলে সমস্যা যেমন শেয়ার করতে পারবেন তেমনি পরিকল্পনাও সাজাতে পারবেন। তবে সাক্ষাৎয়ের পূর্বে অবশ্যই ফোন করে কিংবা মেইল করে মেন্টরকে থেকে সময় ও স্থান জেনে নিবেন। প্রথম সাক্ষাৎেই আপনি কি ধরণের সাপোর্ট বা পরামর্শ চান তা খুলে বলুন এবং মেন্টর আপনাকে কিভাবে সহায়তা করতে পারেন তাও ঠিক করে নিন।
প্রতিবার সাক্ষাৎরের পূর্বে প্রস্তুতি নিনঃ
কি জানতে চান, কি নিয়ে কথা বলবেন তার একটি তালিকা তৈরি করে নিন যাতে করে স্বল্প সময়ে সব কিছু জেনে নিতে পারেন। যা জানতে চান সেই সম্পর্কে আপনার অভিমতও ব্যাক্ত করতে পারেন। সচরাচর চার ধরণের প্রশ্ন রেডি করে রাখতে পারেনঃ ক্যারিয়ার বিষয়ক আলোচনা, সমসাময়িক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ, আপনার সম্পর্কে মেন্টরের বর্তমান মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধিতে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় ইত্যাদি।
মেন্টরশিপের উপকারিতাটুকু গ্রহণ করতে জানতে হবেঃ
মেন্টরিং আসলে এক ধরণের অংশীদারিত্বের মধ্যেও পড়ে। মেন্টি যেমন অভিজ্ঞতার গল্প শুনে নিজেকে শানিত করতে পারে পাশাপাশি মেন্টরও মেন্টরশিপের মাধ্যমে অনেক নতুন কিছু জানতে পারেন মেন্টির সাথে আলাপ আলোচনার সময়ে। স্পেশালি বিভিন্ন ইন্ডাষ্টি এবং এদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়। আবার মেন্টির প্রফেশনাল উন্নতিতে অবদান রাখতে পেরে মেন্টরও এক ধরণের মানসিক প্রশান্তি পেয়ে থাকেন।
মেন্টরের সাথে যোগাযোগ রাখুনঃ
শুধু যে সমস্যায় পড়লেই মেন্টরের ধারস্ত হবেন ব্যাপারটা আসলে তা নয়, নতুন চাকুরী প্রাপ্তি কিংবা আপনার ক্যারিয়ারের যে কোন সাফল্যে মেন্টরদেরকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না। অপরদিকে আপনার মেন্টরের ক্যারিয়ারের যে কোন সাফল্যেও ‘অভিনন্দন’ জানাতে এক মুহূর্ত দেড়ি করবেন না। এভাবেই মেন্টর–মেন্টির সুন্দর সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
“পেয়ার মেন্টরিং”-এর সহায়তাও নিতে পারেনঃ
সাধারণত আমরা মেন্টর নির্বাচন করি আমাদের থেকে যিনি অনেক অনেক অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ এমন কাউকে। কিন্তু যদি এমন হয় যে – দু’জন মানুষ একই রকম লাইফ স্টেইজ বা ক্যারিয়ার স্টেইজে আছেন কিংবা সহকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন যেখানে একে অন্যের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন, একে অন্যকে গাইডলাইন দিতে পারেন, খুব সহজে একে অন্যের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ শেয়ার করতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে একে অন্যকে সহায়তা করতে পারেন যাকে পেয়ার মেন্টরিং বলা হয়ে থাকে। আপনি চাইলে “পেয়ার মেন্টরিংও” চালিয়ে যেতে পারেন।
আসলে মেন্টর আমাদেরকে সাপোর্ট দেন, অনুপ্রেরণা যোগান, যেকোন সমস্যার সমাধান সহ ফিডব্যাক দেন এবং আইডিয়া দিয়ে আমাদের চলার পথকে সহজ করে দেন। সেই সাথে আত্নবিশ্বাস যোগানো আর চিন্তার পরিধি বাঁড়াতেও কাজ করে থাকেন। আর এইসব কিছুই আমাদেরকে পুরো ক্যারিয়ারে সাফল্য পেতে অবদান রাখে।
আজকে যারা কর্পোরেট এবং অন্যন্য সরকারি-বেসরকারি সেক্টরে সাফল্যের সাথে কাজ চলেছেন, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজে সফলতার দেখা পেয়েছেন; চাইলেই কিন্তু আপনি আপনার চারপাশের মানুষকে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে অল্প কিছু শেয়ার করতে পারেন যা হয়তোবা তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম। দরকার শুধু স্বদিচ্ছা আর আপনার মূল্যবান সময় থেকে সামান্য সময়ের।
Follow me on Facebook . Check out my Website .
1 Comment
[…] চলা উচিৎ। একজন রিপোর্টিং বস কখনো একজন ভালো মেন্টর, কখনো মোটিভেটর কিংবা কোচ আবার কখনো […]