একটি তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে যাদেরকে অনেকেই গুগল প্রজন্ম বলে সম্মোধন করে থাকি এবং যারা ইউটিউবেও সমান পারদর্শী। যারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় দেখতে চায়; যারা পৃথিবীকে নতুনভাবে তাদের মতো করে সাজানোর স্বপ্নে বিভোর। যাদের রয়েছে অফুরান প্রাণশক্তি‚ দুরন্ত সাহস আর দূর্বার যাদের চলার গতি। এই তরুণেরা ছিনিয়ে আনে বিশ্বজুয়ের মুকুট; লুঙ্গী আর পাঞ্জাবি পড়ে গামছা গলায় ঝুলিয়ে যারা ব্রিটিশ রাণীর কাছ থেকে ইয়ং লিডারশিপের পদক গ্রহণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়! এই তরুণেরাই সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখায় বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা ‘ফোর্বস থার্টি -এশিয়া ‘ অঞ্চলের সেরা ৩০ জনের তালিকায় চলে আসে অনায়াসেই। আমাদের এই তরুণদের ডাক আসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘ওবামা ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক আয়োজিত ওবামা সামিটে অংশগ্রহণের জন্য। এদেশের তারুণ্যে যাত্রী তরুণীরাও পিছিয়ে নেই। আমাদেরই সুমাইয়া কাজী সেরা তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তার উদ্ভাবনী শক্তির দ্বারা ওয়েব- বেইজড সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্ম sumazi.কম গড়ে তুলে সারা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দেন। বিশ্বে শত শত ক্রিকেটারের ভীরে আমাদের সাকিব আল হাসানই বয়ে নিয়ে আসেন শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ক্রিকেটারের মুকুট। সেই সাথে সারা ক্রিকেট দুনিয়ায় টিটুয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরি করে বেড়ান তিনি ।
বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে ফেসবুক ইভেন্ট খুলে এই তরুণেরা – ই টাকা সংগ্রহ করে দূর্গত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে থাকে। আজকের তরুণেরাই যেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি; তাদের হাত ধরেই আসবে আগামীর মুক্তি।
কিছুদিন আগে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় ধ্বসের ঘটনার কথাই ধরা যাকনা। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে তরুণরা এগিয়ে আসে ফেসবুক ইভেন্ট নিয়ে‚ আহ্বান জানায় সামর্থ্য অনুযায়ী সবাইকে এগিয়ে আসার; অনুদান সংগ্রহের পর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে সেগুলো ট্রাকে তুলে পাড়ি দেয় দূর্গত পাহাড়ি জনপদে। শেষে সর্বস্ব হারিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর হাসিমাখা মুখগুলো ভিডিও আপলোড দেয় ফেসবুকে! এই এক অসাধারণ দৃশ্য আর অভূতপূর্ব অনুভূতি।
সহপাঠী কিংবা পরিচিত কারো বৃদ্ধ বাবা- মা অসুস্থ‚ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মিলছে না অর্থাভাবে! ব্যাস‚ আবারো এই সমাজকে বদলে দেয়ার প্রত্যয়ে তরুণ দল এসে একসাথে জড়ো হয়। ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে শুরু হয় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ। রাত দিন পরিশ্রম করে এই ক্লাস থেকে ওই ক্লাস‚ এক বিভাগ টু অন্য বিভাগ‚ এই ফ্যাকাল্টি টু ওই ফ্যাকাল্টি ‚ অফিস পাড়া থেকে অভিজাত বিপণিবিতান বাদ যায়না কিছুই। এরা অর্থাভাবে কারো চিকিৎসা বন্ধ হতে দেয়না। মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সমাজকে বদলে দিতেই যেন এই তারুণ্যের জন্ম।
দেশের জাতীয় যেকোন দূর্যোগেই সর্বদা এগিয়ে আসে আমাদের এই তরুণদল। এই যেমন কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য এরা বেশ কোমর বেধেঁ মাঠে নেমে পড়েছিলো। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ট্রাক বোঝায় ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে নিয়ে যায় টেকনাফ শরনার্থী ক্যাম্পে। শুধু তাই নয় ‚ গরীব কৃষকের সাহায্যার্থে মাঠ থেকে ধান কেটে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কৃষাণীর মুখে হাসি ফোটাতেও এই তরুণদের জুড়ি নেই।
দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দর্শনীয় স্থানগুলো তরুণদের কাছে নতুন করে ধরা দিচ্ছে। প্রায়ই তরুণদের দলবেঁধে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়তে দেখা যায় রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট‚ বিছানাকান্দি কিংবা নেত্রকোনার বিরিশিরি অথবা বান্দরবানের নাফাখুম‚ রেমাক্রী‚ বড় পাথর আর চিংড়ি ঝর্নাতে মন ভিজিয়ে নিতে। তারা শুধু নিজেরাই ঘুরে তৃপ্ত নয় বরং আকর্ষণীয় স্থানের ছবি আর ভিডিও আপলোড করে দেশ-বিদেশের সবার কাছেও স্থানগুলোকে চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে। যা পর্যটন শিল্প বিকাশে অবদান রাখছে। আবার কিছুদিন পূর্বে একদল ছেলেমেয়েকে দেখলাম দলবেঁধে ট্রাকে করে বন্দরনগরী থেকে সীতাকুন্ড ঝর্নার উদ্যেশ্যে রওনা দিতে। তার অল্প কিছুদিন পর তাদের দেখা গেল ইফতার সামগ্রী নিয়ে এক এতিম খানায় হাজির হতে। এরাই আগামীকে বদলে দেবে; পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
রকিং স্টাইলের মিউজিক পাগল তরুণদেরকেও দেখি ক্যান্সার আক্রান্ত এক পিতাকে বাচাঁনোর জন্য কনসার্টের আয়োজন করে অর্থ সংগ্রহ করতে। কিংবা জটিল কোন রোগে আক্রান্ত কারো চিকিৎসার জন্য ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে অর্থ সংগ্রহে করতে। আবার শীত আসলেই দেশের উত্তরাঞ্চলের শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের কাজে এই তরুণদেরকেই ফেসবুকে ইভেন্ট খুলেতে দেখি। এভাবেই তারুণ্য সমাজকে বদলে দিতে চায়। বদলে দিতে চায় পুরো বিশ্বকে।
এখনকার তরুণের দল এতোটাই স্মাট যে-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নিজ উদ্যোগে জব ফেয়ার আর ক্যারিয়ার বিষয়ক সেমিনার – ওয়ার্কশপের আয়োজনের মাধ্যমে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই ফ্রীল্যান্সিংসহ অন-লাইন ভিত্তিক ব্যবসা ও নানামুখী কাজের মাধ্যমে নিজেকে এগিয়ে নেওয়া তথা সমাজকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সমাজকে কিছু দেয়া-ই যেন এখনকার তরুণদের মুলমন্ত্র । সেজন্যই এই তরুণদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা-ই যায়।
প্রায়শই আমরা অনলাইন মিডিয়ায় আমাদের তরুণদের নানান প্রতি্যোগীতায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখে বিশ্ব মঞ্চ মাতানোর সংবাদও দেখতে পায়, যা আমাদেরকে আরো বেশী করে আশাবাদী করে তুলে।
অন্যদিকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রবাসী তরুণেরাও দুনিয়া মাতাচ্ছেন তাদের অসাধারণ সব কাজের মাধ্যমে। এই যেমন যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী নাফিস বিন জাফর, যিনি একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী এবং অ্যানিমেশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি প্রথম বাংলাদেশী ব্যক্তি হিসেবে চলচিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার অস্কার জেতেন ২০০৭ সালে। আরেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী জাওয়াদ করিম যিনি ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট ‘ইউটিউবের’ সহ- প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। সমাজকে এগিয়ে নিতে দেশে আর দেশের বাইরে আমাদের তরুণেরা যে জেগে উঠেছে সেটা নির্দ্বিধায় বলা- ই যায়।